শোধ বোধ
– প্রলয় কুমার নাথ
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সুনিপুণ হাতে সাজাচ্ছিল নিশা। ওর গায়ের রঙ বেশ পরিষ্কার, তাই গোলাপী রঙের পিওর সিল্ক শাড়িটা ওকে বেশ ভালোই মানাচ্ছে। মানানসই লিপস্টিক, আই লাইনার এবং যথাকিঞ্চিত অন্যান্য প্রসাধনীতেই কি অপরূপা লাগছে তাকে। আজ প্রসূন তার মাকে প্রথম নিয়ে আসছে এই বাড়িতে, ওর মায়ের আবার হালকা সাজই পছন্দ। তবে খোঁপায় রজনীগন্ধার মালাটা নিশার যে কোন শুভ মুহূর্ত উপলক্ষ্যে প্রিয় সাজ, তা সে বিয়ে বাড়ি হোক বা অন্য কোন অনুষ্ঠান। প্রসূনের ওকে উপহার দেওয়া সেই পারফিউমটারই সুবাস নিজের গায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার সাথে সাথে বেজে উঠল ওর বাড়ির ডোর-বেল। নিজের ঘর থেকেই নিশা শুনতে পেল ওর মাসী দরজা খুলে ওদের আপ্যায়ন করে ভেতরে ঢোকালেন। তারপর ওদের বসিয়ে কিছু কথাবার্তা বলে এক ফাঁকে নিশার কাছে এসে হাসিমুখে বলে গেলেন,
– “ওরা এসে গিয়েছেন, ঝটপট তৈরি হয়ে চলে আয়…”
নিজেকে এক ঝলক আয়নায় দেখে নিয়ে প্রসূন আর তার মায়ের কাছে চলে গেল নিশা।
খুব অল্প বয়সেই মা বাবাকে হারায় নিশা। মায়ের মৃত্যু তো তার জন্মের কয়েক মুহূর্ত পরেই হয়, ওর বাবা ইহলোক ত্যাগ করেন যখন ওর চার বছর বয়স। তারপর থেকেই ওর মা বাবার ভূমিকা পালন করেছিলেন ওর মাসী আর মেসোমশাই। তাদের কাছেই সেই চার বছর বয়স থেকে মানুষ হয়েছে নিশা। গত বছর গত হয়েছেন ওর মেসোমশাই, তাই ওর পরিবারে ও ছাড়া এখন আছেন শুধু ওর মাসী। প্রসূনের সাথে নিশা একই অফিসে চাকরি করছে প্রায় দুই বছর ধরে। সেই সূত্রেই দুজনের আলাপ যা পরিণতি পেয়েছে প্রেমে। দুই পরিবারের সম্পূর্ণ মত আছে তাদের এই সম্পর্কে। ছবিতে অনেকবার দেখালেও, আজ প্রথম বার প্রসূন তার মা সুরঞ্জনা দেবীকে নিয়ে এসেছে নিশার সাথে আলাপ করাতে। হয়তো আজকেই স্থির হতে পারে প্রসূন আর নিশার বিবাহের দিনক্ষণ। বাড়ির ড্রইং রুমের ঝকঝকে কাঁচের সেন্টার টেবিলটা জুড়ে ওরা বসেছিল সবাই। মাঝে রাখা ছিল ধূমায়িত কফি, মিষ্টি, সিঙ্গারা এবং আরো নানাবিধ সুখাদ্য। হাসি ঠাট্টায় বেশ কাটছিল ওদের সময়টা। নিশা দেখল যে তার হবু শ্বাশুড়ি সুরঞ্জনা দেবী খুব খোলামেলা মনের মিশুকে মানুষ, একেবারেই সিনেমা সিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়িদের মতো নন। নিশা ভাল ক্লাসিকাল গায় শুনে তার খালি গলার বেশ কয়েকটা গান শুনতে চাইলেন তিনি। নিশার গলার মিষ্টি আওয়াজ যেন মুগ্ধ করল সকলকে।
কিছুক্ষণ পর একটু কুণ্ঠা মেশানো স্বরে নিশা সুরঞ্জনা দেবীকে বলে উঠলো,
– “আসলে মামণি, আমি নিজের পরিবার সম্পর্কে কোন কথাই গোপন করিনি আপনাদের কাছে। শুধু একটি কথা আমি এতদিন প্রসূনকে জানাতে চাইনি, যা আমি এখন বলতে চাই আপনাদের কাছে…”
বেশ অবাক হয়ে প্রসূন আর তার মা তাকালো নিশার দিকে।
– “কি কথা নিশা?” জিজ্ঞাসা করলো প্রসূন।
– “তোমাকে তো বলেইছি যে আমি ছোটবেলায় চার বছর বয়স অবধি দিল্লিতে কাটিয়েছিলাম। মাকে তো হারিয়েছিলাম আমার জন্মের সময়, আর বাবাকে হারালাম যখন আমার বয়স চার বছর। তবে আমার মায়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক হলেও, বাবার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না!”
– “কেন, কি ভাবে মারা গিয়েছিলেন তিনি?” জিজ্ঞাসা করলেন সুরঞ্জনা দেবী।
– “তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন!” প্রসূন আর তার মাকে চমকে দিয়ে বলেছিল নিশা। তারপর বেশ কিছুটা সময় ওরা সকলেই যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর নিশা বলতে শুরু করল,
– “দিল্লিতে একটি নামী খবরের কাগজের সংস্থায় কাজ করতেন আমার বাবা। সব কিছুই ভালো চলছিল, আমার জীবনে মায়ের অভাব থাকলেও বাবা যেন তা কখনো বুঝতে দিতেন না। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই বাবার চাকরিটা কি কারণে চলে গেল তা আমিও জানি না। তখন থেকেই খুব মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লেন আমার বাবা। হয়তো সেই জন্যই একদিন রাত্রে ঘুমের ওষুধের গোটা শিশিটাই ফাঁকা করে দিলেন নিজের মুখে!” স্তব্ধ হল নিশা, প্রসূন দেখল পুরোনো স্মৃতিগুলো যেন অশ্রু হয়ে জমাট বেঁধেছে নিশার দুই চোখে। সে থামলে তার মাসীমা বলতে শুরু করলেন,
– “ওদের নিকট আত্মীয় বলতে এক আমারাই যা ছিলাম। তাই ওর বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে আর দেরি করিনি। কলকাতা থেকে ছুটে গিয়েছিলাম দিল্লিতে। তারপর মাতৃপিতৃহারা ওইটুকু দুধের শিশুটিকে ওখান থেকে নিয়ে এলাম কলকাতায়। আমরা নিজেরা নিঃসন্তান ছিলাম। ওকে পেয়ে মনে হয়েছিল যেন এতদিনের বঞ্চিত সন্তান সুখ আবার ফিরে পেলাম।”
– “প্রসূন…আমি তোমাকে এতদিন এই সব কথা বলতে পারিনি…কি জানি বারবার মনে হয়েছে এই কথাটা আমাদের সম্পর্কের মাঝে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না তো? কিন্তু আজ যখন আমাদের বিয়ের কথা চলছে…তখন আর পারলাম না এই কথা গোপন করতে! এখন তুমি যদি এটা জানার পরও আমায় বিয়ে করতে রাজি থাকো…” প্রসূনের কিছু বলার আগেই নিশার দুই হাত আঁকড়ে ধরলেন সুরঞ্জনা দেবী। তারপর স্নেহার্দ কণ্ঠে তিনি বললেন,
– “ছি ছি মা…এই ভাবে বলছ কেন? হ্যাঁ মানছি একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছে তোমার শৈশবে, কিন্তু তার জন্য তো তুমি কোন অংশে দায়ী নও! আর আমি আমার সন্তানের মন বুঝি, তোমার মত সেও তো তার বাবাকে হারিয়েছে অনেক অল্প বয়সে, তাই আপনজনকে হারানোর ব্যাথা কি তা সেও জানে! তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, তোমার বাবার আত্মহত্যার ঘটনা কখনই তোমার আর প্রসূনের বৈবাহিক জীবনে কোন প্রভাব ফেলবে না!”
নিশা আর তার মাসীর মুখে স্বস্তির হাসি ফুটলো। ওদিকে প্রসূনও নিশার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে উঠলো।
আরো কয়েকটা কথার ফাঁকে সুরঞ্জনা দেবী নিশাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– “দিল্লির কোন সংস্থায় কাজ করতেন তোমার বাবা?”
-“দ্যা ইন্ডিয়া টাইমস…খুব নাম করা ইংরেজি খবরের কাগজ, এখনো বেরোয়!” নিশার উত্তর শুনে বেশ কৌতূহলী হয়ে আবার প্রশ্ন করলেন সুরঞ্জনা দেবী,
– “তোমার বাবার নাম কি ছিল নিশা?”
-“স্বর্গীয় শুভঙ্কর গাঙ্গুলী, মামণি” এই বলে অদূরে দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবির দিকে ইশারা করে সে আবার বললো,
-“ওই যে মামণি, ওই দেখুন ওটা আমার বাবা আর তার কোলে আমি…মাসীমণির কাছে শুনেছি ওটা নাকি আমার ছয় মাস বয়সের ছবি…”
সুরঞ্জনা দেবী এতোক্ষণ খেয়াল করেননি ছবিটাকে। এবার তিনি হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে চশমাটা বার করে চোখে বসিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে।
***
আজ রবিবার তাই অফিস নেই। দুপুরে বিছানায় শুয়ে প্রসূনের কথাই ভাবছিল নিশা। ভাবছিল তাদের বিয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সম্বন্ধে যার তারিখ মাস খানেক পরেই স্থির হয়েছে। ফোন থেকে নিজের আর প্রসূনের পুরোনো ফটোগুলো দেখতে দেখতে যেন একটা স্বপ্নের রাজ্যে প্রবেশ করেছিল সে। এরই মধ্যে বাবাকে ভীষণ মিস করছিল নিশা। আজ যদি তার বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা জেনে নিশ্চয় খুব খুশি হতেন তিনি। ভাবতে ভাবতে নিশা এগিয়ে গেল দেওয়ালে টাঙানো তার আর বাবার ছবিটার দিকে। ছবিতে বাবার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে বলে উঠলো,
-“কেন এমন করলে বাবা? কি এমন ঘটেছিল তোমার জীবনে যে এত বড় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হলে তুমি? ঘুমের ওষুধগুলো খাওয়ার সময় কি একবারের জন্যও তোমার আমার কথা মনে হল না? ভাবলে না তোমাকে ছাড়া আমার কি হবে? কি ভাবে বাঁচবো আমি? সেদিন যদি সাক্ষাৎ দেবদেবীর জুটির মত মাসীমণি আর মেসোমশাই ওখানে না পৌঁছতেন তাহলে…” ভাবতে ভাবতে কখন যে তার দুই চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে গেল সে নিজেও বুঝতে পারল না। এমন সময় তার হাতে ধরা মোবাইলটা বেজে উঠতেই তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। নিশা চোখ মুছে ফোনটা রিসিভ করেই বলল,
-“হ্যাঁ প্রসূন…বলো…এতক্ষন তোমার কথাই ভাবছিলাম জানো…ভাবতে ভাবতে বাবার কথা…”
কিন্তু নিশার কথা শেষ না হতেই ফোনের ওপার থেকে উৎকণ্ঠার স্বর ভেসে এলো প্রসূনের গলা থেকে,
– “নিশা…আমাদের বাড়ির কাছে যে লাইফ-লাইন হাসপাতাল আছে, তুমি সেখানে তাড়াতাড়ি চলে এস…ইটস আর্জেন্ট!”
আর কিছু না বলেই ফোন কেটে দিল প্রসূন। হঠাৎ হাসপাতালে কেন আসতে বলছে প্রসূন? কার কি হল আবার? দুরু দুরু বুকে একবার মাসীকে বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল নিশা। একটি ট্যাক্সি ডেকে সে ধরল লাইফ-লাইন হাসপাতালে যাওয়ার পথ।
***
হাসপাতালের প্রসস্থ বারান্দায় রাখা বসার জায়গায় থমথমে মুখে মাথা নিচু করে বসেছিল প্রসূন। নিশা ব্যস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
– “কি হয়েছে প্রসূন? হঠাৎ এইভাবে এখানে ডেকে পাঠালে?”
– “আজ সকালের দিকে হাতের শিরা কেটে মা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে নিশা…এখন মা এই হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তারবাবু বলছেন ওনার অবস্থা আশঙ্কাজনক…এখানে আনার আগেই শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে!”
– “কি বলছো তুমি?” নিশার মনে পড়ে যাচ্ছে তার বাবাকে হারানোর কথা, “সে কী! কিন্তু তিনি হঠাৎ করে কেন করতে গেলেন এমন কাজ?”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল প্রসূন। ওর মুখে যেন অন্ধকার নেমে এল। তারপর পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বার করে নিশাকে দিয়ে বললো,
– “মা হাত কাটার আগে এটা লিখে রেখে যান। ওনার ঘর থেকেই এটা পেয়েছি। পড়ে দেখ…তোমার প্রশ্নের উত্তর এর মধ্যে আছে!”
বিস্মিত নিশা কাগজটার দিকে চোখ নামিয়ে পড়তে লাগল। সুরঞ্জনা দেবী লিখেছেন:
“প্রসূন,
জানিনা যখন তুই এই চিঠিতে লেখা কথাগুলো পড়বি, তখন আমি এই পৃথিবীতে থাকবো কি না। তবে এই কথাগুলো জানার দরকার তোর থেকে বেশি নিশার। তোদের খুব বেশি সময় নেব না, গৌরচন্দ্রিকা না করে আসল কথাটা বলি। তোর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন একটি পথ দুর্ঘটনায় তোর বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমি পড়লাম অথৈ জলে। মৃত্যুর আগে তেমন কিছুই সঞ্চয় করে যেতে পারেনি তোর বাবা। কি করব, কি ভাবে সংসারের খরচ যোগাব, কি ভাবে তোর স্কুলের ফিস ভরব এই সব ভাবতে ভাবতে আমার রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল। ইংরেজি নিয়ে মাস্টার্স করা ছিল, তাই চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগলাম। কলকাতার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি পেলাম। মাইনে অল্প ছিল, তাই শুরু করলাম স্কুলের বাইরে ছাত্র ছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট টিউশন পড়ানো। বুঝতেই পারছিস, আমি এতক্ষন ধরে বাড়ির বাইরে থাকার ফলে তোকে দেখাশোনা করার তেমন সুযোগ পেতাম না। তাই বাধ্য হয়েই তোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোকে ভর্তি করেছিলাম কলকাতার একটি আবাসিক স্কুলে। এখনো মনে পরে তোর কচি মুখের জল ভরা দুই চোখের কথা যেদিন তুই আমাকে টাটা করে ওই স্কুলে চলে গলি। এরপর আবাসিক স্কুলে থাকাকালীন তুই কিছুই জানতে পারিসনি আমি কি করেছি, কোথায় গেছি, কিভাবে অর্থ উপার্জন করেছি এবং সর্বোপরি কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছি। এখন সেটাই বলার সময় এসেছে।
তোর সাত কি আট বছর বয়স, তখন আমি দিল্লি থেকে একটি চাকরির অফার পেলাম। মাইনে যথেষ্ট ভাল, কাজও আমার পছন্দের তাই পাড়ি দিলাম দিল্লির ‘দ্যা ইন্ডিয়া টাইমস’ খবরের কাগজের অফিসে। সেই সময় সেখানেই চাকরি করতেন নিশার বাবা শুভঙ্কর বাবু। তিনিই ছিলেন আমার বস! প্রথম দেখাতেই আমি আকৃষ্ট হলাম তার প্রতি। তারপর থেকেই চেষ্টা করতে লাগলাম নানা কাজের অছিলায় ওনাকে নিজের কাছে পেতে। জানতাম ওনার স্ত্রী বেঁচে নেই, তাই আমাদের মধ্যে বাধার সৃষ্টি আর কেউ করবে না। আকারে ইঙ্গিতে ওনাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে ওনাকে আমি অন্য চোখে দেখি। ভেবেছিলাম উনি পুরুষ মানুষ, নিজেকে খুব বেশিদিন দূরে রাখতে পারবেন না আমার মত সুন্দরী মহিলার কাছ থেকে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম, ওর প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল এক তরফা। উনি কখনো আমাকে ওনার অধীনস্ত কর্মচারী ছাড়া অন্য কোন চোখে দেখেননি। উপেক্ষার আগুনে জর্জরিত হয়ে ওনার প্রতি আমার সমস্ত ভালোবাসা যেন প্রতিহিংসার রূপ নিতে থাকল। মনে হল আমি কি এতই ফেলনা যে আমার দিকে একবার তাকাতেও নেই? একদিন যখন উনি অফিসের একটা কাজের জন্য আমায় ডেকে পাঠালেন, তখন আমি গিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলাম ওনার কেবিনের দরজা। তারপর ওনাকে জড়িয়ে ধরে জানালাম আমার মনের কথা। কিন্তু উনি সেই মুহূর্তে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে বললেন। হেরে যাওয়ার আগে শেষ মরণ কামড়টা দিয়ে ফেললাম আমি। নিজেই খুলে ফেললাম নিজের শাড়ির এক অংশ, ছিঁড়ে দিলাম নিজের ব্লাউজের দুই দিক। ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওনার গায়ের ওপর, আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করলাম ওনার বুক, পিঠ, মুখ। সাথে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলাম,
– “কে আছো বাঁচাও আমায়…শুভঙ্কর স্যার আমাকে রেপ করার চেষ্টা করছেন!”
ওনার ঘরে কোন সিসিটিভি ছিল না এবং সেটাই ছিল আমার সৌভাগ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসের বাকি স্টাফরা আমাকে ওনার হাত থেকে ‘উদ্ধার’ করলেন। আমার মত দুঃখী অবলা নারীর দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারল না কেউ। তাছাড়া ওই অফিসের বেশ কিছু উপর মহলের স্টাফদের সাথে আগে থেকেই ওনার রেষারেষি ছিল। অফিস কর্তৃপক্ষ নিজেদের সম্মান বাঁচাতে আমাকে আইনের দ্বারস্থ হতে মানা করলেন, এবং এই ‘অন্যায়ের’ শাস্তি স্বরূপ ওনাকে স্যাক করলেন। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছিস চাকরি হারিয়ে কেন মানসিক ভাবে এত ভেঙে পড়েছিলেন শুভঙ্কর বাবু যে উনি আত্মহত্যার পন্থা বেছে নিলেন!
এরপর আমিও বেশিদিন আর কাজ করিনি ওই অফিসে। কলকাতায় আরেকটি ভালো অফার পেয়ে ফিরে আসি। মনে মনে নিজের করা ভুলের জন্য আফসোস হলেও সময়ের সাথে সেটা ভুলে যেতে থাকি। কখনো ভাবিনি আমার সেই কলঙ্কময় অতীতের কথা তোকে জানানোর প্রয়োজন হবে। কিন্তু সেদিন নিশাকে দেখতে গিয়ে আমার বুঝতে কিছুই বাকি রইল না, যে মেয়েটিকে আমার একমাত্র ছেলে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, আমিই হলাম সেই মেয়েটির বাবার আত্মহত্যা করার পেছনের একমাত্র কারণ। বুঝতে পারলাম যে এই সম্পর্ক হলে আমার সেই কৃতকর্মের কথা কোন না কোন দিন কোন না কোন ভাবে তোদের দুজনের সামনে প্রকাশিত হবেই। তখন কি হবে? আমার জন্য তোদের সংসারে ভাঙ্গন ধরবে না তো? অথচ তোর মুখের দিকে চেয়ে নিশাকে মেনে না নিয়েও উপায় ছিল না যে! দগ্ধে দগ্ধে মারছিলাম এত বছর আগেকার ওই পাপ কর্মের জ্বালায়! তাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। একজন নিরাপরাধ মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার মত অপরাধ করে আমার নিজেরও বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই! সম্পূর্ণ স্ব-ইচ্ছায় নিজেকে শেষ করতে চলেছি আমি! হয়তো এভাবেই নিজের কৃতকর্মের শোধ বোধ করার কথা ঈশ্বর লিখে গিয়েছেন আমার কপালে। নিশাকে দিস এই চিঠিখানি, আর বলিস পারলে আমাকে ক্ষমা করতে।
ইতি,
তোর হতভাগিনী মা।”
চিঠিটা পড়ে পাথর প্রতিমার মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিশা। ওদিকের জানলা দিয়ে আসা একটি দমকা বাতাস কখন উড়িয়ে নিয়ে গেল তার হাতে ধরা চিঠিটাকে, সে নিজেই বুঝল না। হঠাৎ একজন নার্স এগিয়ে এল তাদের কাছে, এসে বললো,
-“আপনারাই তো সুরঞ্জনা বোস-এর রিলেটিভ, রাইট? ঈশ্বরের অসীম কৃপা যে আমরা ওনাকে বাঁচাতে পেরেছি। ওনার জ্ঞান ফিরেছে!”
প্রসূন তখনই মাকে দেখার জন্য নার্সের সাথে তার কাছে ছুটতে উদ্যত হল। কিন্তু নার্সটি বলে উঠলেন,
– “এক মিনিট প্রসূন বাবু!”, বলে তিনি এগিয়ে এলেন নিশার কাছে, তারপর তাকে বললেন,
-“সুরঞ্জনা দেবী বারবার নিশা বলে একটি নাম উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। আই হোপ আপনিই নিশা দেবী, তাই তো? তাই প্রসূন বাবুর সাথে আপনিও প্লিজ আসুন ওনার সাথে দেখা করতে!”
প্রসূন আকুতির দৃষ্টিতে তাকাল নিশার দিকে। নিশার মনে হল তার পায়ের নিচের মাটিটা যেন থরথর করে কাঁপছে। তার সামনে রয়েছে তার ভালোবাসা, তার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন। ওদিকে তার পেছনে রয়েছে তার বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা, তাকে যে এইভাবে নিজের জীবনটা শেষ করতে বাধ্য করেছে তার ওপর চরম ঘৃণা এবং প্রতিশোধস্পৃহা! কোন রাস্তাটা বেছে নেবে সে? ওর মাথা ঘুরতে লাগল…এই মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্ত যে নিতেই হবে তাকে!
হঠাৎ যেন বাবার সেই পরিচিত কণ্ঠস্বরটা বেজে উঠল তার কানে। তিনি যেন তাকে বলছেন,
– “আমার জন্য ভেবে নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে সারা জীবন কষ্ট পাসনি মা! যখন বেঁচে ছিলাম তখন তোর চোখের জল দেখে আমার বুক ফেটে যেত রে মা! তাই তুই কষ্টে থাকলে আমি যে মরেও শান্তি পাবে না! তুই এগিয়ে যা তোর ভালোবাসার দিকে, যে আমাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিল সে নিজেও খুব অনুতপ্ত। নিজেও আমার রাস্তাই ধরতে চলেছিল সে! তাই সব ভুলে ক্ষমা করে দে তাকে, মনে রাখিস ক্ষমাই হল পরম ধর্ম!”
অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে নিশা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল প্রসূনকে। যেন তার মনের সকল গ্লানি, সকল বিতৃষ্ণা ধুয়ে মুছে গেল এই পবিত্র প্রেমজ আলিঙ্গনে।
– “কই, চলুন…আমাদের নিয়ে চলুন মামণির কাছে!”, ব্যস্ত হয়ে নার্সকে বলে উঠল নিশা। তারপর সে এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে প্রসূনের হাত ধরে এগোতে লাগল সুরঞ্জনা দেবীর রুমের দিকে, এক ভেঙে পরা অনুতপ্ত মানুষকে ক্ষমা এবং ভালোবাসা দিয়ে পুনরায় সজীব করার অভিপ্রায়ে!
(সমাপ্ত)